সাধু ও চলিত রীতি সর্বনাম ও ক্রিয়া পদের পার্থক্য
বাংলাদেশের মানুষ তাদের মনের ভাব প্রকাশের জন্য যে ভাষা ব্যবহার করে, তার নাম বাংলা ভাষা। বাংলাদেশের বাইরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং ঝাড়খন্ড, বিহার, উড়িষ্যা, ত্রিপুরা, আসামের করিমগঞ্জ ও কাছাড়ের অধিবাসীদের একটি অংশের মাতৃভাষা বাংলা। বস্তুত, দেশ-জাতি-ধর্মনির্বিশেষে বাঙালি জনসমাজে ব্যবহৃত শব্দ নিয়ে বাংলা ভাষা গঠিত। বাংলা ভাষা প্রায় দেড় হাজার বছরের পুরনো। দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহারের ফলে বাংলা ভাষার বিভিন্ন রুপের সৃষ্টি হয়েছে। উল্লেখ্য, পৃথিবীর সব ভাষাতেই দুটো রুপ দেখা যায়। একটি লেখার ভাষা, অন্যটি মুখের ভাষা। ভাষারীতির দিক থেকে বাংলা ভাষার দুটি রূপ বা রীতি লক্ষ্য করা যায়। একটি সাধু ভাষায় এবং অপরটি চলিত ভাষা।
সাধু ভাষা
সাধু ভাষা বাংলা ভাষার একটি প্রাচীন লিখিত রূপ। বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন ও মধ্যযুগে পদ্যই ছিল ভাব প্রকাশের প্রধান বাহন। মধ্যযুগের কপিতয় ক্ষেত্রে চিঠিপত্র, দলিল-দস্তাবেজে গদ্যের ব্যবহার গেলেও তা ছিল খুবই সীমিত। ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে বাংলা গদ্যে গ্রন্থ প্রণয়নের প্রয়োজন দেখা দেয়। ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ কে কেন্দ্র করে গদ্যে চর্চা শুরু হয়। সেদিনকার গদ্যে লেখকগণ গ্রন্থ রচনা করতে গিয়ে মূলত নির্ভর করলেন সাধুজনের মধ্যে ব্যবহৃত সংস্কৃত ভাষার ওপর। এভাবে উনিশ শতকে বাংলা গদ্যের যে লিখিত রুপ গড়ে ওঠে তার নাম দেয়া হয় সাধু ভাষা। সাধু ভাষা সম্পর্কে ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন "সাধু ভাষা সমগ্র বঙ্গদেশের সম্পত্তি। এর চর্চা সর্বত্র প্রচলিত থাকতে বাঙালির পক্ষে ইহাতে লেখা সহজ হইয়াছে।"
বস্তুত বাংলা গদ্যের প্রাথমিক পর্যায়ে মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, অক্ষয় কুমার দত্ত প্রমুখ পণ্ডিত সংস্কৃত ভাষার অনুসরণে তৎসম শব্দবহুল যে সাহিত্যিক গদ্যরীতি করে তোলেন, তা-ই সাধু ভাষা হিসেবে স্বীকৃত।
সাধু ভাষার প্রামাণ্য সংজ্ঞার্থ
💬 সাধারণত গদ্য-সাহিত্যে ব্যবহৃত বাংলা ভাষাকে সাধু ভাষা বলে।→ ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়।
💬 বাংলা ভাষা বাংলা ভাষায় সংস্কৃত শব্দ-সম্পদ ক্রিয়া ও বানান এর পূর্ণরূপ এবং ব্যাকরণসিদ্ধ উপাদান ব্যবহার করিয়া ইংরেজি গদ্য-সাহিত্যের পদবিন্যাস প্রণালীর অনুসরণে পরিকল্পিত যে নতুন সার্বজনীন গদ্যরীতি বাংলা সাহিত্যে প্রবর্তিত হয়, তাহাকে বাংলা সাধু ভাষা বলে।→ ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক
মূলত যে ভাষা রীতিতে ক্রিয়াপদ ও সর্বনামপদ পূর্ণরূপে বর্তমানে থাকে, তা-ই সাধু ভাষা। যেমনঃ তাহারা খেলিতেছে। উহারা ঘুমাইয়া রহিয়াছে।
চলিত ভাষা
কোন একটি প্রধান ভাষার আওতাভুক্ত সমগ্র ভূখণ্ডের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন কথ্যরুপ বা মৌখিক ভাষা ব্যবহৃত হয়। মুখের ভাষায় লিখিত ভাষায় ব্যবহার করার উদ্দেশ্যে চলিত ভাষার প্রচলন হয়। তবে সবার মুখের ভাষায় চলিত ভাষা নয়, কারণ মুখের ভাষা পরিবর্তন হয়। তাই নির্দিষ্ট অঞ্চলে একটি নির্দিষ্ট এলাকার শিক্ষিত ও শিষ্টজনের ভাষাকে মান চলিত ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। উল্লেখ্য, ভাগীরথী নদী তীরবর্তী এলাকায় এবং কলকাতার
ভদ্র ও শিক্ষিত সমাজে ব্যবহৃত একটি সর্বজনবোধ্য আদর্শ কথ্য ভাষা গড়ে তোলা হয়। এটাই হলো বাংলার আদর্শ চলিত ভাষা। বাংলা ভাষাভাষী শিক্ষিত জনগোষ্ঠী এ ভাষাতেই তাদের পারস্পারিক ভাবের আদান প্রদান করে থাকে। চলিত ভাষা বর্তমানে একাধারে লেখার ভাষা ও মুখের ভাষা।
চলিত ভাষার প্রামাণ্য সংজ্ঞার্থ
💬 দক্ষিণ-পশ্চিমবঙ্গে ভাগীরথী নদীর তীরবর্তী স্থানের ভদ্র শিক্ষিত সমাজে ব্যবহৃত মৌলিক ভাষা, সমগ্র বাংলাদেশের শিক্ষিত সমাজ কর্তৃক শ্রেষ্ঠ মৌখিক ভাষা বলে গৃহীত হইয়াছে। এই মৌলিক ভাসাজে বিশেষ ভাবে চলিত ভাষা বলা হয়।→ ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়।
💬 তদ্ভব শব্দ, সংকুচিত ক্রিয়া, সর্বনাম পদ এবং লেখকের এর মনোভাব অনুসারে পদবিন্যাস প্রণালীর ব্যবহারসহ স্বচ্ছন্দ, চটুল ও সার্বজনীন সাহিত্যিক গদ্যরীতি কলিকাতা ও ভাগীরথী তীরবর্তী অঞ্চলের মুখের ভাষার আদলে গড়িয়া উঠিয়াছে, তাহার নাম চলিত ভাষা। → ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক
মূলত যে ভাষারীতিতে ক্রিয়াপদ ও সর্বনামপদ সংক্ষিপ্ত আকারে ব্যবহৃত হয় তাকে চলিত ভাষা বলে। যেমনঃ তারা খেলছে। ওরা ঘুমিয়ে রয়েছে।
প্রধানত ক্রিয়াপদ ও সর্বনাম পদের পার্থক্য বিবেচনা করে সাধু ভাষা ও চলিত ভাষা নিরুপণ করা হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়ঃ "তাহারা পড়িতেছে" বাক্যটিতে দুটি পদ আছে। তাহারা সর্বনাম পদ এবং পড়িতেছে ক্রিয়াপদ। সাধুভাষার উল্লিখিত পদ দুটোতে সর্বনাম পদ ও ক্রিয়া পদ ব্যবহৃত হয়েছে। এবার বাক্যটিকে চলিত ভাষায় রূপান্তর করলে তার রুপ দাঁড়াবে "তারা পড়ছে"। এক্ষেত্রে বাক্যটিতে "তারা" সর্বনাম পদ এবং "পড়ছে" ক্রিয়াপদ সংক্ষিপ্ত আকারে ব্যবহৃত হয়েছে।
সাধু ভাষার ক্রিয়াপদঃ করিতেছি, খাইয়াছি, বলিতেছি, যাইতেছি ইত্যাদি।
চলিত ভাষার ক্রিয়াপদঃ করেছি, খেয়েছি, বলছি, যাচ্ছি ইত্যাদি।
সাধু ভাষার সর্বনাম পদঃ তাহার, তাহারা, তাহাদের, উহাদের ইত্যাদি।
চলিত ভাষার সর্বনাম পদঃ তার, তারা, তাদের, ওদের ইত্যাদি।
Comments
Post a Comment
👉 মন্তব্যের ক্ষেত্রে পড়াশোনা বিডির নিয়মাবলী পড়তে ক্লিক করুন এখানে।