সুচনাঃ খুব ছোটবেলায় আমি একাধিকবার ট্রেন ভ্রমণ করেছি, কিন্তু সেসব আমার ভালো মনে নেই। যে ট্রেন ভ্রমণটি আমার স্মৃতিতে উজ্জ্বল তা হলো চট্টগ্রাম থেকে শ্রীমঙ্গলের উদ্দেশ্যে যাত্রা।
ভ্রমণ কি?: অজানাকে জানার জন্য মানুষের রয়েছে দুনির্বার আকর্ষণ। নতুন নতুন জিনিস স্বচক্ষে দেখে সে সম্পর্কে জ্ঞানলাভের জন্য মানুষ পারি জমায় দেশ-বিদেশের নানা স্থানে। অজানাকে জানার উদ্দেশ্যে এই স্থানান্তরের নামই ভ্রমণ। ভ্রমনের মাধ্যমে মানুষ বিশ্বকে সবচেয়ে ভালোভাবে অনুভব করার সুযোগ পায়।
ভ্রমনের পথসমুহঃ স্থল, জল, আকাশ সমস্তই এখন মানুষের করায়ত্ত। এই সবগুলো পথেই রয়েছে ভ্রমণের অবারিত সুযোগ। স্থলপথে বাস, ট্রেন, রিকশা ইত্যাদির মাধ্যমে ভ্রমণ করা যায়। নদীপথে লঞ্চ, নৌকা আর আকাশ পথে বিমান হেলিকপ্টার মানুষের ভ্রমণের বাহন। তবে দীর্ঘ দুরুত্বে আরামদায়ক ভ্রমণের জন্য ট্রেন ভ্রমণের জুড়ি নেই।
ট্রেন ভ্রমণের শুরুঃ তখন আমি ক্লাস সিক্সে পড়ি। বার্ষিক পরিক্ষা শেষ হয়ে গেছে। হাতে লম্বা ছুটি, শীতও তখন মাত্র শুরু হচ্ছে। এমনি সময়ে আমার ছোট খালা আমাদের মৌলভীবাজারে আমন্ত্রণ জানালেন। যাত্রার তারিখ ঠিক করে বাবা টিকেট কেটে আনলেন। যাত্রার দিন অটোরিকশায় চড়ে চট্টগ্রাম স্টেশনে পৌঁছলাম। প্লাটফর্মে কুলিরা ছুটে এলো। কিন্তু আমরা যার যার ব্যাগ নিজেরাই কাঁধে তুলে নিলাম। প্লাটফর্মে নানা ধরনের মানুষের ভিড়। কেউ আমাদের মতোই যাত্রী। কেউ বা এসেছে আত্মীয়-স্বজনদের বিদায় বা অভ্যর্থনা জানাতে। আরও আছে কুলি, ফেরিওয়ালা, ভিক্ষুক।
রেলস্টেশনের অভিজ্ঞতাঃ প্রায় দশটার সময় ট্রেন প্লাটফর্মে এলো। আমরা দ্রুত ট্রেনে উঠলাম। আমাদের সিট পড়েছে সামনাসামনি। আমি ও আমার ভাই জানালার পাশের সিট দুটো দখল করলাম। বাবা জানালেন, ট্রেন ছাড়তে দেরি হবে। শুনে আমার ছোট ভাই খুব রেগে গেল। বাবাকে বলল, ''যাও, ওদের বকে দিয়ে এসো। তাড়াতাড়ি ট্রেন ছাড়তে বলো। খালা আমাদের জন্য কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবেন!'' ওর কথা শুনে আমরা তো হেসেই খুন।
ট্রেনে বসে দেখা দৃশ্যঃ যা হোক, ট্রেন ছাড়ল প্রায় আধা ঘণ্টা পর। ট্রেন চলতে শুরু করল। প্রথমে ধীরে ধীরে, তারপর বেশ দ্রুত। প্রথম দিকে দেখা গেল শহরের সেই পরিচিত দৃশ্য一 দালানকোঠা, দোকানপাট, বাস-ট্রাক, রিকশা-সাইকেল। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই দৃশ্য পাল্টে গেল। বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত, সবুজ মাঠ ও মাঠে চরে বেড়ানো গরু-ছাগলের দল চোখের সামনে ছবির মতো ভেসে উঠল। ট্রেন ছোটার সঙ্গে মনে হলো রেললাইনের পাশে গাছপালা, বিদ্যুতের খুঁটি, ঘরবাড়ি লোকজন, রাস্তা, পুল一 সব যেন উল্টোদিকে ছুটে যাচ্ছে। জানালা দিয়ে দূরে ছোট ছোট বাড়িগুলোকে মনে হতে লাগল যেন একেকটা দ্বীপ। সে এক অপূর্ব দৃশ্য। হটাৎ চোখে পড়ল রেললাইনের পাশে সমান্তরাল মহাসড়ক। তাতে ছুটে চলছে বাস, ট্রাক। একটা বাস আমাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে গেল। কিন্তু যানজটে আটকে তাকে পিছিয়ে পড়তে হলো। প্রায় এক ঘণ্টা পর আমরা বড় পুল পার হলাম। বাবা জানালেন, আমরা ফেনী নদী পার হচ্ছি। কয়েকটা নৌকা চোখে পড়ল। এরপরই দৃশ্য পাল্টে গেল। আবার সেই গ্রাম আর মাঠের দৃশ্য।
ট্রেনের ভিতরের অবস্থাঃ এদিকে ট্রেনের কামরায় এক অন্ধ বাউল গান শুরু করল। খুব সুন্দর তার গলা। কয়েকটা গান গাওয়ার পর সে সবার কাছে হাত পাতল। আমরা তাকে দশটা টাকা দিলাম। একটু পরপরই বিভিন্ন ফেরিওয়ালা আসতে থাকল। একটা স্টেশনে ট্রেন থামলে কমলাওয়ালা উঠল। বাবা তার কাছ থেকে তিন ডজন কমলা কিনে নিলেন। দুপুরের দিকে মা টিফিন ক্যারিয়ার খুললেন। খুব মজা করে হাতে হাতে আমরা পরোটা আর মাংস ভুনা খেলাম। হটাৎ বাইরে তাকাতে চোখে পড়ল সারি সারি তালগাছ। আর সে গাছে ঝুলছে বাবুই পাখির বাসা।
বিভিন্ন স্টেশনঃ ট্রেনের জানালার পাশে বসায় দেখতে পেলাম অনেকগুলো নাম না জানা স্টেশন। একে একে ট্রেন পেরিয়ে গেল মিরেরসরাই, সীতাকুণ্ড, ফেনী, আখাউরা ইত্যাদি জায়গা। স্টেশনগুলোতে ট্রেন থামতেই শুরু হয়ে যায় যাত্রীদের হুড়োহুড়ি আর কুলিদের হাঁকডাক।
উল্লেখযোগ্য স্থানঃ ট্রেন ভ্রমণের শুরুতেই আমার নজর কেড়ে নেয় চট্টগ্রাম রেলস্টেশন। এত বড়ো স্টেশন এই প্রথমবার এলাম আমি। সীতাকুণ্ডের ভেতর দিয়ে যাওয়ার পথে চোখে পড়ল বেশকিছু পাহাড়ের সারি। সিলেট থেকে শ্রীমঙ্গল যাওয়ার অনেকটা পথ ঘন সবুজ জঙ্গল আর ছোট ছোট টিলায় ঘেরা। বেশকিছু নয়নাভিরম চা বাগানের দৃশ্যও চোখে পড়ে। ট্রেনে ভ্রমণের সময় চমৎকার এই স্থানগুলো আমাকে মুগ্ধ করে রাখে।
বাস স্টেশনঃ দেখতে দেখতে ফুরিয়ে এলো আমাদের ট্রেন ভ্রমণ। বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে আমরা পৌঁছে গেলাম শেষ স্টেশন শ্রীমঙ্গলে। ব্যাগপত্র সব গুছিয়ে নেমে এলাম ট্রেন থেকে। প্লাটফর্মে খালু আর খালাতো ভাইবোনেরা আমাদের অপেক্ষা করছিলেন। তাদের সঙ্গে চললাম মৌলভীবাজারের উদ্দেশে।
উপসংহারঃ জীবনে অনেকবার আমি ট্রেনে চড়েছি। গেছি এক শহর থেকে আরেক শহরে। কিন্তু শ্রীমঙ্গলে যাওয়ার স্মৃতি আজও ভুলিনি।
Comments
Post a Comment
👉 মন্তব্যের ক্ষেত্রে পড়াশোনা বিডির নিয়মাবলী পড়তে ক্লিক করুন এখানে।